History

ইনগ্রাহাম স্যার আইজ্যাক নিউটন: আধুনিক বিজ্ঞানের পথিকৃৎ

আইজ্যাক নিউটন, এক বিখ্যাত ইংরেজ বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ এবং দার্শনিক, যিনি আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছেন।

নিউটনের শৈশব

নিউটনের জন্মের সময় তার পিতা মারা যান, এবং তার মাতা দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে তিনি দাদির কাছে বড় হন। নিউটন ছিলেন খুবই মেধাবী এবং কৌতূহলী স্বভাবের। তিনি তার পড়াশোনায় অতুলনীয় মনোযোগ দিতেন। ছোটবেলায় খেলনা তৈরিতে তার অসাধারণ দক্ষতা ছিল। তিনি বিভিন্ন মেশিনের মডেল বানাতেন এবং এই মডেলগুলো অনেক জটিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করে।
নিউটনের শৈশবটি ছিল তার বয়সের অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় ভিন্ন। তার জন্মের পরপরই তার পিতা মারা যান, এবং তার মা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। নিউটনের প্রতি তার মা’র ভালোবাসা এবং যত্নের অভাব ছিল, যা তার উপর গভীর প্রভাব ফেলে। তিনি তার দাদির কাছে বড় হয়েছিলেন, এবং এ কারণে তিনি শিশু বয়সেই বেশ একাকীত্ব অনুভব করতেন। এই একাকীত্ব তার মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রকৃতির প্রতি গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল।

ছোটবেলায়, নিউটন সাধারণ খেলাধুলার চেয়ে খেলনার মডেল তৈরি করতে বেশি সময় কাটাতেন। তিনি নিজ হাতে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি এবং মডেল বানাতেন, যা তাকে পরবর্তীতে যন্ত্রবিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণার দিকে নিয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে যে, ছোটবেলায় তিনি একটি সূর্যঘড়ি তৈরি করেছিলেন, যা তার সময়ের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন ছিল। এছাড়াও তিনি জল চাকা এবং উইন্ডমিলের মডেলও তৈরি করেন, যা তার যান্ত্রিক দক্ষতার প্রমাণ।

নিউটনের শিক্ষাজীবন:

নিউটনের প্রাথমিক শিক্ষা স্থানীয় স্কুলে শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে, তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, যেখানে তার বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিকাশ ঘটে। ক্যামব্রিজে তিনি গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস, এবং কেপলারের মতো বিজ্ঞানীদের কাজ অধ্যয়ন করেন। ১৬৬৫ সালে নিউটন ‘কালক্রম’ এর ভিত্তি তৈরি করেন, যা গণিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এই সময়ে তার উদ্ভাবনী চিন্তাধারায় ক্যালকুলাস, প্রিজমের মাধ্যমে আলোর বিচ্ছুরণ, এবং মহাকর্ষ তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন:

আইজ্যাক নিউটন যখন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তখন সেই সময়কার সর্বোত্তম শিক্ষকদের অধীনে তার পড়াশোনার সুযোগ হয়। সেখানে তিনি গ্যালিলিও, কেপলার, এবং ডেসকার্টেসের কাজগুলি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। তার অধ্যয়নের সময়, ১৬৬৫-১৬৬৬ সালে প্লেগের কারণে ক্যামব্রিজ বন্ধ হয়ে গেলে, নিউটন তার গ্রামে ফিরে আসেন এবং নিজেই গবেষণা চালিয়ে যান। এই সময়ে, তিনি ক্যালকুলাস, বাইনমিয়াল থিওরেম, এবং আলোর তত্ত্বে তার মৌলিক কাজগুলির ভিত্তি স্থাপন করেন। এই সময়ে তিনি পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের তত্ত্ব সম্পর্কেও ভাবনা চিন্তা শুরু করেন।

নিউটনের অবদান:

নিউটনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে ‘ফিলোসোফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেমাটিকা’ বা সংক্ষেপে ‘প্রিন্সিপিয়া’ রয়েছে। এই বইয়ে তিনি গতি এবং মহাকর্ষের মূলনীতি বর্ণনা করেছেন। নিউটনের প্রথম সূত্র, যা বলছে “একটি বস্তুর উপর কোনো বাহ্যিক বল না থাকলে, তা স্থির থাকে বা সমবেগে চলতে থাকে,” এটি পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। তার দ্বিতীয় সূত্র বলছে, “একটি বস্তুর উপর প্রয়োগিত বলের মান সমান তার ভরের গুণিতক বেগের পরিবর্তনের হারের সমান।” এবং তৃতীয় সূত্র বলছে, “প্রত্যেক ক্রিয়ার বিপরীতে সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে।” এই সূত্রগুলো বৈজ্ঞানিক বিশ্বের মৌলিক নিয়ম হিসেবে পরিচিত।

নিউটন ক্যালকুলাসের ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রেখেছেন। যদিও ক্যালকুলাসের আবিষ্কারের ক্ষেত্রে গটফ্রিড উইলহেল্ম লাইবনিজের নামও জড়িত, নিউটন এবং লাইবনিজ প্রায় সমসাময়িকভাবে ক্যালকুলাসের সূত্রাবলি উদ্ভাবন করেন। ক্যালকুলাসের এই তত্ত্বগুলি পরবর্তীতে বিজ্ঞান এবং প্রকৌশলে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

নিউটন আলোর প্রকৃতির উপরেও গবেষণা করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে সাদা আলো প্রিজমের মাধ্যমে ভাঙলে বিভিন্ন রঙের আলোতে বিভক্ত হয়। এর দ্বারা তিনি আলো এবং রঙের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন, যা পরবর্তীতে বর্ণবিদ্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

মহাকর্ষীয় তত্ত্বের আবিষ্কার:

নিউটনের মহাকর্ষীয় তত্ত্ব আবিষ্কার সম্পর্কিত একটি জনপ্রিয় কাহিনী রয়েছে। বলা হয়, একদিন নিউটন একটি আপেল গাছের নিচে বসে ছিলেন, এবং একটি আপেল তার মাথায় পড়ে। এ ঘটনায় তিনি চিন্তা করতে শুরু করেন কেন আপেলটি সোজা মাটির দিকে পড়লো এবং অন্যদিকে গেলো না। এই ঘটনাটি তাকে মহাকর্ষীয় শক্তি সম্পর্কে ভাবতে উদ্দীপিত করে এবং তিনি এ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। যদিও এটি একটি জনপ্রিয় মিথ্যা কাহিনী হতে পারে, তবুও এটি নিউটনের মহাকর্ষীয় তত্ত্বের বিকাশের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখা হয়।

এই তত্ত্বটি পরবর্তীতে ‘প্রিন্সিপিয়া’ গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়, যা তাকে বিখ্যাত করে তোলে। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব কেবলমাত্র পৃথিবীতে বস্তুগুলোর গতিবিধি ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয়, এটি মহাকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের চলাচল ব্যাখ্যা করতেও সক্ষম।

ধর্ম এবং দার্শনিক চিন্তা:

নিউটন শুধুমাত্র বিজ্ঞানী ছিলেন না, তিনি একজন গভীর দার্শনিক এবং ধর্মীয় চিন্তাবিদও ছিলেন। তিনি বাইবেল এবং ধর্মীয় গ্রন্থগুলি নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করতেন এবং এসব নিয়ে তিনি বহু নিবন্ধ লিখেছেন। তার মতে, ঈশ্বর এই বিশ্বকে পরিচালনা করছেন এবং বিজ্ঞান তার সৃষ্টি করা নিয়মের মধ্যেই কাজ করে। যদিও তার কিছু চিন্তা তৎকালীন সময়ে বিতর্কিত ছিল, তবুও তিনি নিজেকে একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান হিসেবে দাবি করতেন।

নিউটনের ব্যক্তিগত জীবন:

আইজ্যাক নিউটন খুবই নির্জনপ্রিয় এবং একাকী জীবনযাপন করতেন। তিনি কখনোই বিয়ে করেননি এবং পুরো জীবন তিনি তার গবেষণা ও অধ্যয়নে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। তার ব্যক্তিত্ব ছিল নির্ভীক, এবং তিনি ছিলেন আত্মনির্ভরশীল। নিউটনের জীবনে একাধিক চ্যালেঞ্জ আসলেও, তিনি কখনোই পিছু হটেননি।

মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার:

নিউটন ১৭২৭ সালের ২০শে মার্চ মারা যান। মৃত্যুর পরেও নিউটনের কাজ ও তত্ত্বগুলি যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে প্রভাব বিস্তার করছে। তিনি আজও আধুনিক বিজ্ঞানের পিতামহ হিসেবে পরিচিত। তার মহাকর্ষ তত্ত্ব, ক্যালকুলাস, এবং আলোর গবেষণা বিজ্ঞানীদের জন্য এক অবিস্মরণীয় দিকনির্দেশনা হয়ে থাকবে। নিউটনের অবদানকে আমরা কেবলমাত্র তার যুগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করতে পারি না; তিনি পুরো মানব সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসের একটি অমূল্য অংশ।


নিউটনের শেষ জীবন:

নিউটন তার জীবনের শেষ সময়ে খুবই সম্মানিত এবং বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। ১৬৯৯ সালে তিনি রয়্যাল মিন্টের ওয়ার্ডেন নিযুক্ত হন, যা তার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটায়। তিনি ১৭০৩ সালে রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি নিযুক্ত হন এবং ১৭০৫ সালে রানী অ্যান দ্বারা নাইট উপাধি লাভ করেন।

তার শেষ জীবনও বিজ্ঞান ও গবেষণার মধ্যেই কেটেছে। তবে তার বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি শরীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং ১৭২৭ সালে ৮৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর, তাকে ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে সমাহিত করা হয়, যা ছিল তার যুগের মহান মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি প্রতীক।

উত্তরাধিকার ও প্রভাব:

আইজ্যাক নিউটনের অবদান বিজ্ঞানের ইতিহাসে অপরিসীম। তার উদ্ভাবন, তত্ত্ব এবং গবেষণাগুলি পরবর্তী প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের জন্য পথপ্রদর্শক হয়েছে। আলবার্ট আইনস্টাইনও নিউটনকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন এবং বলেছেন, “নিউটন আধুনিক বিজ্ঞানের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।”

নিউটনের কাজ এবং চিন্তাধারা আজও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছে। তার অবদানগুলি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন, মহাকাশ গবেষণা, ইঞ্জিনিয়ারিং, এবং গণিতের মধ্যে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন যে মানুষ যদি মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিন্তা করতে পারে, তবে তারা অবিশ্বাস্য কিছু আবিষ্কার করতে পারে।

নিউটনের জীবন এবং কাজ থেকে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাই—একটি প্রশ্ন বা কৌতূহলই হতে পারে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সূচনা। নিউটন কেবলমাত্র বিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক দূরদর্শী, যিনি মানুষের চিন্তাধারার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছিলেন এবং ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

উপসংহার:

আইজ্যাক নিউটনের জীবন ও কাজগুলো বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। তিনি কেবল বিজ্ঞান ও গণিতের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেননি, বরং তার চিন্তাধারা পরবর্তীতে বহু গবেষণার ভিত্তি স্থাপন করেছে। তার উদ্ভাবনী কাজগুলো আজও বিজ্ঞানের পথে পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করছে। নিউটনের জীবন ও কাজগুলি প্রমাণ করে যে মানুষ যখন মনোযোগ ও উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগায়, তখন অসাধারণ কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব।

Md Sakib Khan

আমি মো. সাকিব হোসেন, যশোরের নার্সিং ও মিডওাইফারি কলেজের ছাত্র। লেখালেখির প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে, যা আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে এবং সৃজনশীলভাবে চিন্তা করতে সহায়তা করে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button